মোঃ রনি রজব ভোলাহাট উপজেলা (প্রতিনিধি)
সমাজসেবী, সাদামনের আলোকিত মানুষ জিয়াউল হক ।১৯৩৪ সালের ৬ জুন চাঁপাইনবাবগঞ্জে জেলার ভোলাহাট উপজেলার সীমান্তবর্তী ৩নং দলদলী ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ড এর অন্তর্ভুক্ত (চামা মুশরীভূজা )গ্রামের এক অতি দরিদ্র পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। বাবা তৈয়ব আলী মোল্লা আর মাতা শরীফন্নেশার ঘরে এক বোন, দুই ভায়ের পর জন্ম তার । দারিদ্রতার মধ্যে বড় হওয়া জিয়াউল হকের পিতা পেশায় একজন দুধ বিক্রেতা। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হয়ে কোন রকমে সংসার চালাতেন ।জিয়াউল হক ১৯৫৫ সালে ৫ম শ্রেণি পাশ করেন।এবার ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হবার পালা,জিয়াউল হক তখন তাহার বাবা বললো যে,বাজান আমি ৫ম শ্রেণি পাশ করে এবার ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হবো তাই তুমি আমাকে ১ টাকা ২ আনা দিয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণীর একসেট বই কিনে দাও।তার কথার জবাবে বাবা বললো,জিয়াউল আমি তোমাদের আজ ৩ দিন থেকে অর্ধাহারে অনাহারে রেখেছি এই টাকার অভাবে আর তুমি আমার কাছে ১ টাকা ২ আনার বই কিনে চাচ্ছো সেই টাকা আমি কোথায় পাবো,আচ্ছা তুমি পড়া ছাড়ো। আমি তো গ্রামে গাভি দহন করি তুমিও আমার পেশাতে চলে এসো।জিয়াউল পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে তার বাবার পেশায় যোগ দেয় অর্থাৎ গাভি দহনে নিযুক্ত হয়। গাভি দহন করতে করতে মাথায় বুদ্ধি এলো যে এই দুধ বাইরে বিক্রি না করে এটা প্রক্রিয়াজাত করে দই তৈরি করলে কেমন হয়।শুরু করলেন দই তৈরি করতে।প্রথমদিন দই তৈরি করলেন তো দই দুধ হয়েই থেকে গেল।পরের দিন দই তৈরি করলেন তো দই অতিরিক্ত টক হয়ে গেল। এভাবে করতে করতে একপর্যায়ে আসল দইয়ে পরিনত হলো। ইতোমধ্যেই একটি বাইসাইকেল হয়েছে তার। অনেক গুলো নড়িতে দই ভর্তি করে বড় ঝুড়িতে মাথাই নিয়ে ছুটে চলেন জেলার বিভিন্ন প্রান্তে । সন্ধ্যার বাড়ি ফিরে নিশি কে নিমন্ত্রণ জানান । এখনো একই ভাবে ৯০ বছর বয়সে ও দই বিক্রি করেন তিনি ।তবে এখন আগের মতো আর পাড়েনা বয়সের চাপে,তাই অটো যোগে জেলার বিভিন্ন জায়গায় দই বিক্রি করছেন তিনি।দই বিক্রি করার পর যখন হাতে কিছু পয়শা হলো তখন তিনার সেই দুর্দিনের কথা মনে পড়ে গেল,যে ১ টাকা ২ আনার জন্য আমি পড়ালেখা থেকে বঞ্চিত হয়েছি তো দেখি আর যেন কোন ছেলে মেয়ে এই টাকার অভাবে আমার মতো লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত না হয়। আর এই দই বিক্রি করে প্রতিদিন দুই-একটি বই কিনতে কিনতে নিজ উদ্যোগে গড়ে তোলেন বিশাল এক পাঠাগার। গ্রামের প্রতিকূল পরিবেশ আর পারিবারিক চরম দারিদ্রতার কারণে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। চরম দারিদ্রতার মধ্যে থেকেও তিনি এলাকার গরীব, মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষার বিভিন্ন উপকরণ কিনে দিয়ে সহযোগিতা করতেন। ১৯৫৯ সালে চামামুশরীভূজা ও পাশের গ্রামের ষষ্ঠ শ্রেণীর পাঁচজন ছাত্রের হাতে পাঁচসেট বই তুলে দেন এবং সেখান থেকেই মূলত তাঁর মহৎ কর্মোদ্দমের শুভ_সূচনা…। শুধু বই নয়- খাতা, কলম, পেন্সিল, চক, ব্যাগ প্রভৃতি শিক্ষা উপকরণ শিক্ষার্থীদের দিতে থাকেন। মাঝে মধ্যে আর্থিক সহযোগিতাও করতেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তাঁর সংগ্রহে অনেকগুলো বই হয়ে গেলে ১৯৮০ সালে বটতলা গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন ‘জিয়াউল হক পারিবারিক পাঠাগার’।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের দৈনিক নবাব, রাজশাহীর দৈনিক দিনকাল, দৈনিক সোনালী সংবাদসহ বিভিন্ন পত্রিকায় এ সম্পর্কে সংবাদ পরিবেশিত হলে তিনি দেশবাসী তথা সর্বসাধারণের কাছে পরিচিতি লাভ করেন। পরবর্তীকালে জিয়াউল হক তাঁর লাইব্রেরীর নাম পরিবর্তন করে ‘জিয়াউল হক সাধারণ পাঠাগার’ নামকরণ করেন।বর্তমানে তার পাঠাগারে বই এর সংখ্যা প্রায় ১৪ হাজার।যে বই গুলো আছে সেগুলো হলো:নাটক,নভেল,ডিটেকটিভ, উপন্যাস, রম্য,রচনা,হাদিস,কুরআন,ফেকাহ,আইনের বই,ডাক্তারি বই গল্পের বই ইত্যাদি। বিভিন্ন সময়ে তাঁর প্রতিষ্ঠিত লাইব্রেরী সম্পর্কে উল্লেখিত দৈনিক ছাড়াও দৈনিক প্রথম আলোসহ বেশ কিছু জাতীয় পত্রিকায় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। ২০০২ সালে একুশে টেলিভিশনে (ইটিভি) ‘জিয়াউল হক ইসলামী পাঠাগার’ সম্পর্কে বিস্তারিত প্রতিবেদেন প্রকাশ হলে দেশ-বিদেশে জিয়াউল হকের মহিমা ও গুণ কীর্তন ছড়িয়ে পড়ে।
২০০৬ সালের ১২ এপ্রিল-১৫ মে , ইউনিলিভার বাংলাদেশ লি. এ্যাডকমের (বিজ্ঞাপনী সংস্থা) সহযোগিতায় দেশবাসীর কাছে ‘সাদা মনের মানুষ’-এর সন্ধান চেয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করে। বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ সবগুলো টিভি চ্যানেল এবং প্রধান প্রধান জাতীয় দৈনিকগুলোতে বিজ্ঞাপন প্রচারিত হলে জনগণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ও উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। তিন হাজার মনোনয়ন জমা পড়ে। দৈনিক পত্রিকার একটি সাংবাদিক দল প্রাথমিকভাবে যাচাই-বাছাই করে। সাংবাদিক দলটি দ্বিতীয় ধাপে ৫০ জনের একটি তালিকা তৈরি করে এনটিভি চ্যানেলের স্থানীয় প্রতিবেদকের সরেজমিন পর্যবেক্ষণ শেষে এ্যাডকম ও ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড ২০ জনের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রস্তুত করে। চূড়ান্ত পর্বে নির্বাচক হিসেবে জাতীয় ব্যক্তিত্ব সাংবাদিক মতিউর রহমান, রোকেয়া আফজাল রহমান ও ড.দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য-এর উপস্থিতিতে শীর্ষ দশ জন ‘সাদা মনের মানুষ’ নির্বাচন করেন। যার মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাটের জিয়াউল হক (দই ওয়ালা) একজন হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।
২০০৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারী ঢাকার হোটেল শেরাটনে গণ্যমান্য অতিথি, সামরিক, সরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা, লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবি, সাংবাদিক, তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাদের সরব উপস্থিতিতে ‘সাদা মনের মানুষ’ হিসেবে নির্বাচিত দশ জনকে আনুষ্ঠানিক সম্মাননা প্রদান করা হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে প্রত্যেককে দু’ভরি ওজনের সোনার মডেল, মানপত্র, এবং দুই লক্ষ টাকা প্রদান করা হয়। জাতীয় পত্র-পত্রিকা এবং ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে উক্ত সংবাদ, তথ্যচিত্র পরিবেশন এবং এনটিভি ‘সাদা মনের মানুষ’ সম্মাননা অনুষ্ঠানের ধারণকৃত পুরো অনুষ্ঠানটি ২০০৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারী সম্প্রচার করে।
জিয়াউল হকের জন্য ২০০৭ সাল ঘটনাবহুল একটি বছর। এইচএসবিসি থেকে অনুদান লাভের পর ইটালী, কানাডা থেকে ২ লক্ষ টাকা এবং নরওয়ে থেকে এক লক্ষ টাকা অনুদান প্রদান করে। সেই সময় দেশ বিদেশের মানুষের অন্তরে তিনি জায়গা করে নেন।আরো জোরালো ভাবে লেগে পড়েন সমাজের কাজে।শুরু করেন সমাজসেবা।কোথায় নলকুপ নেই?সুপেয় পানির অভাবে মানুষ পানি পান করতে পায়না সেখানে নলকুপ স্থাপন করেন এ পর্যন্ত সর্বমোট ১৮ টি নলকুপ স্থাপন করে দেন।কার মাথা গোজার ঠাই বাড়ি নাই! তার জন্য ৭ বান্ডিল করে টিন দিয়ে ১৭ টা টিনসেড বাড়ি নির্মান।কাফনের কাপড় বিতরণ।অসহায়,দুস্থ ব্যক্তি টাকার অভাবে চিকিৎসা করতে পারেনা তাদের আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা।এই পর্যন্ত ৮৫ জন অনাথ, দুস্থের চোখের ছানি মাসুরা অপারেশন করা।প্রতিবছর পবিত্র রমজান উপলক্ষে ৫০০ কুরআন বিতরন করা।প্রতিবছর রমজান মাসে গরিব,অসহায়,দুস্থ, স্বামী হারা,স্বামী পরিত্যক্তা,বিধবা, মহিলা ও পুরুষদের মাঝে সেহরি ও ইফতারের জন্য ৭৫ মন করে চাউল বিতরন করা।প্রতিবছর ২৮ রমজানে ৭ টি মাদ্রাসা ও ৩ টি এতিমখানা সহ ঝিমিয়ে পড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ,মন্দিরে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা।প্রবীন নিবাস ও বৃদ্ধাশ্রম গুলো বাৎসরিক সহায়তা করা।এসব সমাজের কাজ করে থাকেন তিনি। একটা কথা বলে রাখি, বহির্বিশ্বের অনেক মানুষ জিয়াউল হক এর এসব কর্মকান্ড দেখে অনুপ্রানিত হয়ে বিভিন্নভাবে তিনাকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে থাকেন।শিক্ষা ও সমাজসেবায় বিশেষ অবদান রাখার কারণে গতবছর ২০২৪ সালে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ২১ শে পদকে ভূষিত হন তিনি।সেখানে তিনি ৩৫ গ্রাম ওজনের ২২ ক্যারেট মানের একটা স্বর্ণপদক এবং নগদ ৪ লক্ষ টাকার চেক পান।সেই ৪ লক্ষ টাকা তিনি বিভিন্ন ভাবে বিলিয়ে দেন।
"দই বিক্রি করা যার পেশা"
"বই ক্রয় করা তারই নেশা"
"গড়েছেন বিশাল পাঠাগার"
"জিয়াউল এইতো কীর্তি তোমার।
জিয়াউল হক শুধুই একজন ব্যক্তি নন তিনি একটি প্রতিষ্ঠানও বটে।আমি জিয়াউল হক এর সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল কামনা করছি এবং সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করছি তিনি যেন এভাবেই দশ এবং দেশের সেবা করে যেতে পারে।
জিয়াউল হক এর বিখ্যাত একটি স্লোগান হচ্ছে :
"বেচি দই কিনি বই "
সম্পাদক - মোঃ মনির হোসেন