
ময়মনসিংহ জেলা প্রতিনিধি:
ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার মল্লিকবাড়ী বাজার। সপ্তাহে মাত্র একদিন- শনিবারে বসে এই জমজমাট হাট। তবে হাটের সবচেয়ে চেনা ও ব্যতিক্রমী দৃশ্যটি হচ্ছে, বিশাল এক বটগাছের ছায়াতলে বসে থাকা একদল নরসুন্দরের কর্মব্যস্ততা। যুগ বদলেছে, শহরের মোড় ঘুরলেই দেখা মেলে ঝলমলে আধুনিক সেলুনের, কিন্তু এখানকার মানুষ এখনো ছুটে আসেন এই বটতলার নরসুন্দরের কাছে চুল-দাঁড়ি কাটাতে।
এই বটগাছের ছায়াতলে কাটিয়েছেন কেউ কেউ জীবনের অর্ধশতাব্দীও। ত্রিশাল উপজেলার বগারবাজার এলাকার রায়মন চন্দ্র শীল (৭০) বলেন, “আমি পাকিস্তান আমল থেকেই কাজ করছি। তখন হাতে কাজ থাকতো, পকেটে টাকা থাকতো। হাটের দিনে এই বটগাছের নিচে কাজ করেন, বাকি সময় গ্রামে ঘুরে ঘুরে কাজ করেন তিনি। আগে দিনে সাত-আটশ টাকা রোজগার হতো, এখন পাঁচশও হয় না।”
ভালুকার তামাট গ্রামের ইন্দ্রমোহন (৭০) প্রায় দেড় যুগ ধরে এই হাটে নরসুন্দর হিসেবে কাজ করছেন। স্মৃতিচারণ করে বলেন, “আগে হাটের দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যস্ত থাকতে হতো, এখন সেই জৌলুস নেই।
তবে তরুণ প্রজন্মের কেউ কেউ এখনো এই ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। পাঁচগাঁও হাজিরবাজারের সুমন শীল (২৪) নিজের গ্রামে একটি সেলুন পরিচালনা করেন। তবে প্রতি শনিবার চলে আসেন মল্লিকবাড়ী হাটে। তাঁর ভাষায়, “এখানে একটা টান আছে, খদ্দেররাও পরিচিত। পরিবেশটা যেন আপন হয়ে গেছে।
স্থানীয় প্রবীণ নরসুন্দর নুর মোহাম্মদ (৭৩) জানালেন, মাত্র ১০ বছর বয়সে এই বাজারে নরসুন্দর হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। আজও তিনি সেই পেশা ধরে রেখেছেন। বললেন, “আগে সকাল থেকেই সারি করে খদ্দের বসতো। এখন আর সেই ভিড় নেই, তবে প্রতিদিন গড়ে পাঁচশো টাকা আয় হয়।
৯০ বছর বয়সী নিয়মিত খদ্দের ফয়েজ উদ্দিন বলেন, অনেক বছর ধরেই এখানেই চুল-দাঁড়ি কাটাই। সেলুনে গেলে খরচ বেশি হয়, এখানে কম খরচে ভালো কাজ হয়।”
এই বটগাছ, পুরনো কিছু আয়না আর একজোড়া কাঁচির মধ্যে এখনো টিকে আছে এক ঐতিহাসিক পেশা। মল্লিকবাড়ী বাজারের এই নরসুন্দর হাট শুধু একটি পেশার কেন্দ্র নয়- এটি একেকটি জীবনের গল্প, লোকজ সংস্কৃতির জীবন্ত স্মারক।
প্রতি শনিবার বসা এই হাট বহু পরিবারের জীবিকার উৎস এবং অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বপ্ন। ডিজিটাল আধুনিকতার ভিড়ে হারিয়ে যেতে বসা এই ঐতিহ্য যেন এখনো ধুকে ধুকে বেঁচে আছে মানুষের স্মৃতি, মমতা আর প্রয়োজনের জায়গা থেকে।